ইচ্ছে আর চেষ্টাটা চালু ছিল প্রায় বিশ বছর ধরেই। প্রত্যেক বারই ভাবতাম, খোঁজ খবর সংগ্রহ করতাম, টাকা-পয়সার হিসাব অবধি করে, শেষমেশ, টাকা এবং সময় দুটোরই এত প্রবল প্রয়োজন পড়তো, যে নিজেকে বোঝাতাম, ‘ঠিক আছে, সামনের বছর’। ঐ ধরনের অনেকগুলো সামনের বছর ক্রমশ পেছনে ফেলে আসা বছরে প্রর্যবসতি হয়ে মাঝে মাঝে যেন চোখ রাঙ্গাতো আমাকে। আমার তখনকার অবস্থাটা অনেকটা সেই সুরা লগ্নে জন্মানো দার্শনিক-মাতালের মত, যিনি তার প্রেমিকাকে একটি অনবদ্য চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ‘গত বছর পুজায় তোমাকে কিছুই দিতে পারি নাই, এই বার তাহাও পারিলাম না’। (গোপনে জানিয়ে রাখি, এই ভদ্রলোককে আমি খুঁজে চলেছি সারা জীবন ধরে।)
যাই হোক, বছর খানেক আগে, কোনও এক ‘সন্ধ্যাআহ্নিকাসরে’, আমার এক অধ্যাপক মাসতুতো ভাই সজল, (দিনে যার মোবাইলে ব্যালেন্স থাকে না, এবং রাতে শরীরে) হঠাৎ এক ঐতিহাসিক প্রস্তাব প্রসব করে বসলো, ওর অননুকরণীয় সজল কন্ঠে, ‘চল না, একবার মানস সরোবর যাই’। ব্যাস! ধুলো জমতে থাকা কল্পনার ফাইলগুলি, হঠাৎ যেন এক লহমায় আবার নটরাজ, নৃত্যের তালে তালে! মঙ্গলবার কি না মনে পড়ে না, তবে হাতে পাঁজি ছিল না, ছিল অন্য কিছু। সিদ্ধান্ত হয়ে গেল নিমেষেই। এমন কি সজলের পাসপোর্ট বানানোরও। আমি আগেও দেখেছি, জলপথে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজতর। হাজার হোক বাঙ্গাল তো, ওপারে আজ কতটুকুই ইয়ে স্থলপথ? যেহেতু তুলনায় সমস্যা অনেক বেশী, তাই প্রথম থেকে ভাবা ছিল ভারত সরকারের খপ্পরে না পরে, নেপালের দিক দিয়ে যাবো। বিবাহিত পুরুষদের, মাঝে মাঝে যাওয়ার মত কোন বাপের বাড়ি থাকে না, থাকলে নেপাল হোত আমার তাই। ঠাট্টা নয়, কারণ আমাদের বাবার ডাকনামও যে ছিল নেপাল।
রক্সল এক্সপ্রেসে বসেও বিশ্বাস হচ্ছিল না, সত্যি সত্যি কৈলাস-মান্স সরোবর পরিক্রমায় যাচ্ছি। দলের মোট সদস্য ৪৬ যার মধ্যে মাত্র ৪৫ জন অপরিচিত। ভাবছেন তো, ‘সে কি। সজল’? যারা ওকে চেনে তারা আদৌ অবাক হবে না যখন শুনবে যে টানা দশ মাস মনয় পেয়েও সে পাসপোর্ট হাতে পেয়নি! কেরণ, যে দুই বন্ধুকে দায়িত্ব দিয়েছিল তারা দুজনেই সম্ভবত কাল্পনিক চরিত্র! অরণ্যদেব বা গোয়েন্দা রীপের মত। অবশ্য আদ্যন্ত অকমর্ণ্য বা ভুল লোক নির্বাচনের ক্ষেত্রে ওর অতুলনীয় দক্ষতাকেও খাটো করে দেখাটা অসমীচীন।
কাঠমান্ডু পৌঁছালাম বীরগঞ্জের কাছে, কচি একটা এয়ার-স্ট্রিপ থেকে, যার মত খেলনাবাটী বিমান-বন্দর, বোধকরি গোটা দুনিয়াতেই খুব কম আছে। নাম সিমারা। চল্মান সাদা পুতুলের মত বিমান-সেবিকা, সব যাত্রীদের কফি দেওয়া শেষ করতে না করতেই, নামলো বিমান রানোয়ের মসৃণে। হোটেল ‘মারশিয়াংদি’ – যার অর্থ জেনেছিলাম, কিন্তু মনে নেই – সেখানেই তথাকথিত ওরিয়েন্টেশন, পাসপোর্ট পরীক্ষা, ওষুধ পত্র, জ্যাকেট, রেনকোট, উইন্ড-চিটার, খনিজ জল, স্লিপিং ব্যাগ ইত্যাদি ব্যাপক চাষবাসের পর আরম্ভ হল নাপালী গাইড মিষ্টাজ কুঙ্গার ব্রিফিং। চীনের সাথে সময়ের তফাত প্রায় আড়াই ঘন্টার এবং তার জন্য কি কি অসুবিধা হতে পারে থেকে আরম্ভ করে উচ্চাতা জনিত সাবধান বানীর সতর্ক উচ্চারণ।
যাত্রীদের গড় বয়েস ৫৩ থেকে ৫৫। প্রত্যেকেই ভারতীয়, জনা দুয়েক নাপালি ছাড়া। গুজরাত, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, অসম ইত্যাদির পর পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিত্ত, শোচনীয়তম রকমের সংখ্যালঘু। সকলেই নিরামিশাষী এবং সকলেই বিপদজ্জনক রকমের ধার্মিক। পূণ্য অর্জনের তাগিদটা অধিকাংশেরই অন্তিম মোটিভেশন। তিব্বতের আদিগন্ত মালভূমির ব্যাপক্তা, নৈশব্দ, জায়গায়-জায়গায় মানসিক হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসা পাগল-হাওয়ার, যাবতীয় গরম পোশাকের প্রতিবন্ধকতাকে অস্বীকার করার দুর্বার স্পর্ধা, মানস-সরোবরের সংলগ্ন প্রকৃতির, অথবা কৈলাস পাহাড়ের অনবদ্য নির্সগ-আমার বিনীত ধারনা, আর যার জন্যি হোক, আমার এ বারের সহযাত্রীদের জন্য নয়। প্রায় ১৬ হাজার ফুটের ওপর একটা সরোবর, যার পরিধি ৮৫ কিলোমিটার, ক্রমশ বদলাতে থাকা জলের রঙ, চার পাশের বরফাচ্ছাদিত পাহাড় চূড়ার প্রতিফলিত আত্মীয়তা – ঝকঝকে সাদা মেঘ বালিকাদের থিকানা-বিহীন সঞ্চরণকে, দুদন্ড চোখের পাতায় মেখে নেওয়া কিংবা একটুখানি সময় ছুপ করে বসে, ফেলে আসা প্রিয়জনদের সাথে কাটানো দূর! সে সবের জন্য সময় কোথায়? কতক্ষণে পূজা, মন্ত্র বলা, কিংবা সশব্দ ধর্মীয় কুট-কচালীতে মগ্ন হওয়া যাবে, সেটাই বোধহয় অধিক জরুরী। এসব সময় বুঝতে পারি, বুকের একদিকে মানিব্যাগ থাকলে অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ থাকাটা খুব জরুরী- ‘দেবতার বন্দীশালায় আমার নৈবেদ্য পৌঁছাল না’।
এবার আসি তাদের প্রসঙ্গে, যারা না থাকলে, এ সফর হতো অসম্ভব। প্রায় ১৫ দিনের এই যাযাবর সংসার, ভক্তি সাগরে নিমজ্জিত থাকলেও, উদর পুর্তির ব্যাপারে, কখনো কোন অনীহা প্রকাশ করতো না। তাছাড়া, কে না জানে, খালি পেটে ধর্ম হয় না! একটা ট্রাক, তাতে সাপোর্ট স্টাফ, শেরপা, পোর্টার, রাঁধুনি, ডাক্তার অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং গ্যাস-ওভেন সিলিন্ডার, তাছাড়া, ইস্পাত/ থার্মোকলের থালা, প্লেট, গ্লাস, চা ও কফির পেয়ালা, স্যুপের জন্য পাত্র, দুনিয়ার কাঁচা আনাজ, মশলাপাতি, বড় বড় গামলা, ডেচকি – এক কথায় ভ্রাম্যমান সেই রন্ধনশালা ছিল, মুগ্ধ হয়ে দেখবার মতো একটা চলমান বিস্ময়। চার-পাঁচ জনের একটা শেরপা-মাল্বাহক এবং গাইডের দল, প্রত্যেকদিন ভোর-রাত্তিরে, ট্রাক থেকে সরঞ্জাম নামিয়ে, মুখ-হাত ধোয়ার পর জল, চা-কফি বানাতো, সকাল-বিকালে জল-খাবার এবং দুপুর-রাতের ভোজনের ব্যবস্থা করতো। মাল নামানো, মাল তোলা, আনাজ-পাতি কোটা, গোটা তিন-চার উনুনে রান্নার তদারকি, পরিবেশন – আমার কেমন যেন অসম্ভব বলে মনে হতো। সব চাইতে বড় কথা – টানা ১৫ দিন দেখেছি এদের – এক বারের জন্যও কাউকে মেজাজ হারাতে দেখিনি। ঝড়, জল, রোদ্দুর, যাই থাকুক না কেন, মুখের হাসি থাকতো, মানস সরোবরের মতই অনাবিল।
এ লেখাটা আমি কৈলাস-মানস ভ্রমণের সম্পূর্ণ ছবি আঁকতে চাইনি। কারণ তার সঠিক জায়গা এই পত্রিকা নয়, বলতে পারেন আরম্ভের আরম্ভ। পরে কখনোও, অন্য কোনও পৃষ্ঠায়, বিশদে যাওয়ার ইচ্ছে আছে।